ইমাম খাইর, সিবিএন:
কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিতরণে শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুর থেকে কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী। শনিবার দুপুরে ৩৬ বীর, ২৪ বেঙ্গল ও ৬৩ বেঙ্গল নামে ৩টি টীম রোহিঙ্গাদের আশ্রয় স্থল উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী পৌঁছে। এর আগে শুক্রবার সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় এসে চলমান প্রতিটি কাজ পর্যবেক্ষণ করে প্রাথমিক ধারণা নেন। এরপর কোথায় কি করতে হবে তা নির্ধরণ করে তারা ফিরে যান।
এর আগের দিন বৃস্পতিবার সেনা প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক উখিয়ায় কুতুপালং শরণার্থী ক্যা¤েপ চলমান কার্যক্রমের অগ্রগতি পরিদর্শন করেন। এসময় পার্সপোট অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রিদুয়ানসহ অন্যরা এসময় উপস্থিত ছিলেন।
সুত্র জানায়, সরকারীভাবে উখিয়ায় নির্ধারিত ২ হাজার একর জমিতে ১৪ হাজার শেড তৈরি করবে সেনাবাহিনী। প্রতিটি শেডে ৬ জন করে ৮৪ হাজার পরিবার থাকার সুযোগ পাবে। শেড নির্মাণের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমও পরিচালনা করবে সেনাবাহিনী।
রোহিঙ্গাদের জন্য স্থাপিত নতুন সেনা ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার মেজর মুহাম্মদ রাশেদ আকতার এস.পি জানান, পূর্ব সিদ্ধান্ত মতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় এসে সেনা সদস্যরা প্রথমে সড়কে শৃংখলা আনতে কাজ শুরু করে। অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন ও বিচ্ছিন্ন ত্রাণ বিতরণ এবং রাস্তায় রোহিঙ্গাদের অহেতুক জটলা সরিয়ে দিয়ে সড়ক যোগাযোগ নির্বিঘ্ন করা হয়েছে।
তিনি জানান, এরপর কন্ট্রোল রুমে জমা হওয়া দ্রুত পচন যোগ্য তাজা খাবারগুলো আলাদা করে বিতরণের জন্য নেয়া হয়। বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আসা রোহিঙ্গারাই এসব ত্রাণের আওতায় আসছে। এর মাধ্যমে বায়োমেট্রিকের সুবিধার ম্যাসেজটা রোহিঙ্গাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছি। যাতে কচ্ছপ গতি থেকে চলমান এ নিবন্ধন প্রক্রিয়াটা খরগোশ গতিতে আসে।
কাজের সুবিধার্থে উখিয়া ডিগ্রি কলেজের পরিত্যাক্ত একটি কক্ষকে কো¤পানীর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরো জানান, প্রথমদিন হিসেবে শুধু শৃংখলাটা আনায়নে কাজ করছি, তাই শেড নির্মাণে হাত দেয়া যাবে না। রবিবার থেকে একটি টিম শেড নির্মাণের কাজ শুরু করবে।
এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানান, নিপীড়নের শিকার হবার পর আশ্রয়ের আশায় বাংলাদেশে ঢুকে রোহিঙ্গারা। মানবিকতার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিক সহায়তা দিতে নির্দেশ দেন। এরপর থেকে তাদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। শুধু ত্রাণ দিলে হবে না তাদের জন্য সুষ্ট স্যানিটেশন ব্যবস্থা, সুপেয় পানিসহ পরিচ্ছন্ন আবাসন দরকার। তা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হবে। এটি স্থানীয়দের জন্যও হুমকি স্বরূপ। তাই দ্রুততার সাথে শৃংখলিত ভাবে কাজ স¤পন্ন করতে আমরা সেনাবাহিনীর সহায়তা নিচ্ছি।
তিনি আরো জানান, সেনাবাহিনী ক্যাম্পে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করণে রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কারকাজ করবে। পাশাপাশি শৃংখলার সাথে সুষ্টভাবে ত্রাণ বিতরণেও কাজ করবে সেনাবাহিনী।
একারণে সব ধরণের ত্রাণ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রদানের জন্য আবারও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে জেলা প্রশাসক আরো বলেন, শুক্রবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১২৯ ট্রাক ত্রাণসামগ্রী জেলা প্রশাসকের ত্রাণভান্ডারে জমা পড়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জেলা পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন জানান, উখিয়ার ৭১ কিলোমিটার জুড়ে বসানো হয়েছে ১১টি চেকপোস্ট। ২২টি মোবাইল টিম কাজ করছে। ২১২ দালালকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালত।
তিনি আরো জানান, রোহিঙ্গারা যাতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য ২৪ ঘন্টা কাজ করছে তারা। ইতিমধ্যে ৫ হাজার ১১৯ রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানান পুলিশ সুপার।
উল্লেখ্য, গত ২৪ আগষ্ট রাতে মিয়ানমারের কয়েকটি সেনা ও পুলিশের চৌকিতে রোহিঙ্গা জঙ্গি হামলার অভিযোগে আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু করে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। হত্যা, ধর্ষণের পাশাপাশি গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় বর্তমানে সাড়ে চার লাখের বেশী রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তারা কুতুপালং, বালুখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ঘটে হতাহতের ঘটনা। এসব প্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে শুরু সামাজিক সংগঠনগুলো সেনা বাহিনীর হাতে দায়িত্ব দেয়ার আহবান জানায়।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অংসান সুচির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত ৫শ’র বেশি মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতেও বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
এই শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমার তাতে সাড়া দেয়নি। রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতেও তারা রাজি নয়।
রোহিঙ্গাদের এই স্রোত ঠেকাতে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মতো কোনো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে একাধিক নিরাপদ এলাকা (সেইফ জোন) গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ। এছাড়া সীমান্তে যৌথ টহলেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। কিন্তু কোনো প্রস্তাবেই মিয়ানমারের সাড়া মেলেনি। উল্টো তাদের অভিযান সঠিক বলে দাবী করে বিবৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকা- শুরু করে।